মোঃ মিনহাজুল আবেদীন : আফলাতুন ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের রহমতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আব্দুল লতিফ। কৈশোরেই তিনি মাকে হারান। প্রথমে পড়ালেখা করেন স্থানীয় মাদ্রাসায়। পরে নিজ গ্রামে কারগিল হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। পরে জীবিকার তাগিদে চলে আসেন ঢাকায়। তাঁর ঢাকার জীবন অগোছালো। নিজে যা বুঝতেন তাই করতেন। শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও নিজেকে খাটো করতেন না। মার্জিত, রুচিশীল এবং প্রচণ্ডভাবে প্রচারবিমুখ ছিলেন আফলাতুন। মন-মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনায় ছিলেন আধুনিক ও আদর্শবাদী। অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটির বন্ধুর সংখ্যাও ছিলো হাতেগোনা। শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, কায়সুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ ছিলো তার প্রিয়জন।
দৈনিক বাংলার ‘সাত ভাই চম্পা’ শিশুপাতাটি দেখতেন আফলাতুন। তখনকার সময়ে সবচে’ আধুনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। পাতাটি শাদাকালো হলেও রঙে-গুণে-মানে চকচকে ঝকঝকে ছিল। আফলাতুন লেখাগুলো দেখতেন লাল কালির কলমে। লেখায় ভুল-ত্রুটি দেখলেই গোল চিহ্ন দিয়ে বলতেন এগুলো ঠিক করে নিয়ে আসো। পরামর্শ দিতেন। কীভাবে লেখায় উন্নতি করা যায়। গল্পগুলো কীভাবে লিখতে হয়। তখনকার সময়ে দৈনিক বাংলার ‘সাত ভাই চম্পা’য় যাঁদের লেখা ছাপা হতো তাঁদেরই লেখক হিশেবে গন্য করা হতো।
১৪ মে ২০০৬ মারা গেছেন আফলাতুন। তার প্রিয় মানুষ ছিলো সক্রেটিস, প্লেটো, টলস্টয়, গোর্কি, লাচা ও অস্কার ওয়াইল্ড। এঁদের মধ্যে প্লেটোর আরবী নামটিই তিনি ধারণ করেছিলেন লেখালেখির শুরুতে পিতৃদত্ত নামটি আমাদের কাছে অজানা থেকেই গেছে। সাহিত্য ও সাংবাদিক জগতে তিনি আফলাতুন নামেই পরিচিত ছিলেন। আফলাতুন সারাজীবনই সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ সময় ছিলেন দৈনিক পাকিস্তান বা দৈনিক বাংলায়। সাংবাদিকতা শুরু করেন কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত মাসিক সমকালে চাকরি নিয়ে। এর আগে তিনি কিছুদিন শিল্প বিভাগেও চাকরি করেন। খণ্ডকালীন চাকুরে ছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের। জীবনের শেষপর্বে এসে তিনি যোগদান করেন দৈনিক জনকণ্ঠে। তবে দৈনিক পাকিস্তান বা দৈনিক বাংলায় তার চাকরি জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে। দৈনিক বাংলায় তিনি ছিলেন ফিচার এডিটর। ছোটদের জন্য নির্ধারিত ফিচার পাতা সাতভাই চম্পা তিনি সম্পাদনা করতেন। সাতভাই চম্পা সম্পাদনা তার জীবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এদেশে তিনিই প্রথম আধুনিক ও রুচিশীল শিশুতোষ পাতা ছোটদের উপহার দেন এবং একদল তরুণ তাজা লেখক সৃষ্টি করেন, যারা বর্তমান সময়ের নামী-দামী। সাতভাই চম্পার অনেক বৈশিষ্ট্য ছিলো। দু'পৃষ্ঠার সাতভাই চম্পায় ঢাউস ছবি ছাপতেন। গল্প ও ছড়া-কবিতার জুতসই অলঙ্করণ করতেন। বিশেষ সংখ্যায় লেখার সঙ্গে লেখকের ছবি ছাপতেন। আবার প্রথমদিকে সাতভাই চম্পার লোগোতে যাদের একবার লেখা ছাপা হয়েছে, তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতেন এবং প্রতি সপ্তায় তা ছাপা হতো। অভিনব হলো তার মেকআপ-গেটআপ। প্রচণ্ড সাড়া জাগিয়েছিলো সাতভাই চম্পা। তখন সাতভাই চম্পায় নিয়মিত লিখতেন শামসুর রাহমান, বেলাল চৌধুরী, এখলাসউদ্দিন আহমেদ, মোহম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সুকুমার বড়ুয়া, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, আলী ইমাম, পূরবী বসু, ফজল-এ-খোদা, আজমেরী ওয়ারেশ, আখতার হুসেন, মাহমুদউল্লাহ, আবু সালেহ, মসউদ-উশ-শহীদ, আহমদ আনিসুর রহমান, আহমদ নূরে আলম, ইফতেখার হোসেন, আলী আহসান, কাজল, বেবী মওদুদ, রুবী মওদুদ, সিদ্দিকা মাহমুদা, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, কাজী সালাহউদ্দিন, প্রণব চৌধুরী, জামসেদুজ্জামান লাকি প্রমুখ। আবদুল মোহিত, শাহাদাত বুলবুল, আলমগীর বাবুল, রিটন রহমান (লুত্ফর রহমান রিটন), আমীরুল ইসলাম, রোকেয়া খাতুন রুবী, শাহাবুদ্দিন নাগরী, ফারুকী খান রক্সি, আইউব সৈয়দ, আহমাদউল্লাহ, আনিস রহমান, তপংকর চক্রবর্তী, দীপংকর চক্রবর্তী, শাকিল কালাম, আশরাফুল আলম পিন্টু, ফারুক নওয়াজ, আনসার আলী, ইজাজ হোসেন, আবিদ আজাদ, আবু হাসান শাহরিয়ার, আসলাম সানী, আবু কায়সার, ওবায়দুল গনি চন্দন, ঝর্ণাদাস পুরকায়স্থ, দিলওয়ার, দেলোয়ার বিন রশীদ, বিপ্রদাস বড়ুয়া, বুলবন ওসমান, আল মনসুর, মাহবুব তালুকদার, মুরতাজা আলী, লুবনা জাহান, রশীদ হায়দার, রেজোয়ান সিদ্দিকী, শওকত আলী, ফরিদুর রেজা সাগর, শাফিকুর রাহী, শেখ তোফাজ্জল হোসেন, সৈয়দ আল ফারুক, নাজমুল হাসান, হাসান হাফিজ, আবদুর রহমান, ওয়াসিফ-এ-খোদা প্রমুখ। তাদের লেখায় সাতভাই চম্পায় বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিলো।
একজন মননশীল সম্পাদক ও গদ্যের এক নিপুণ কারিগর হিসেবে আফলাতুন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বড়দের কাছে, ছোটদের কাছে।